আবদুর রহিম ও মাহমুদুল হাসান
মার্চ ২২, ২০২০, ০৬:৩২ পিএম
ভয়! তবুও সতর্ক থাকছি না আমরা। অভূতপূর্ব বিপদের মুখে পুরো দেশ। প্রতিদিনই আসছে নতুন আক্রান্তের খবর। গতকালও নতুন তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন। এই সময়ে কী চাই আমরা। এলোমেলো বক্তব্য নাকি সবল নেতৃত্ব? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে সতর্ক থাকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মানছি না নির্দেশনা।
পরিস্থিতি ভয়াবহের কথা জানাচ্ছে রাষ্ট্রের বড় বড় পর্যায় থেকে। স্পষ্ট হচ্ছে পূর্ব দৃশ্যপট! দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় রাখতে এখনি পুরো দেশকে লকডাউন করার দাবি উঠেছে।
তবে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দিতেই সমাধান দেখা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশকে লকডাউন ও জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও বলেছেন— এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
একটি অংশ থেকে বিজ্ঞপ্তি এসেছে, ঢাকা দক্ষিণে দোকান, রেস্টুরেন্ট ও চা-স্টল বন্ধের নির্দেশের। করোনা ভাইরাসের বিস্তাররোধে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আগামী এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পরবর্তী সময়সূচি জানা যাবে। করোনার ভয়ে মাদারীপুরের শিবচরের পর এবার লকডাউন করা হয়েছে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলা। দোকানপাটে আড্ডা নিষিদ্ধ করা হয়েছে সুনামগঞ্জে।
করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের সব স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। এছাড়া জামিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজ মুলতবি করা হয়েছে।
করোনা থেকে রক্ষায় চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে করোনা প্রতিরোধে কী কী উপকরণ দরকার সেটি নির্ধারণ করতে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন ৬৩ জন সচেতন নাগরিক।
এতে বলা হয়— কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে করোনা সংক্রমণের যে চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এর তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ দেশের ভেতরেই এই রোগ কমিউনিটি সংক্রমণের পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মহাবিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেই, সমন্বয় নেই, আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত উপকরণ ও ব্যবস্থাপনা দেশে নেই; নেই চিকিৎসকদের রক্ষার ব্যবস্থা, নেই যথেষ্ট মাস্ক, স্যানিটাইজার ও ভেন্টিলেটর! পরীক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া সরকার আক্রান্ত সংখ্যার যে তথ্য দিচ্ছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না।
দেশের হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান দুর্বলতা ও প্রস্তুতিহীনতা অনুধাবন করে দেশের নাগরিক হিসেবে তারা গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরো দেশ লকডাউনের চিন্তা করা হচ্ছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন— ওষুধের দোকান, মুদির দোকান, সবজি বাজার এবং মাছ, মাংস, ডিম ও দুধের দোকান, অনলাইন শপিং ব্যবস্থা, ব্যাংক, এটিএম, পোস্ট অফিস, ইন্টারনেট পরিষেবা ছাড়া অন্য সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে।
আরো তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত : দেশে আরো তিনজনের শরীরে করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে দুইজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ নিয়ে দেশে ২৭ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন পাঁচজন। আর করোনায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। তাই দেশের অতি বয়স্ক ব্যক্তি ও যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে তাদের অত্যাবশ্যক প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে আহ্বান জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা।
গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর মহাখালীর বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) মিলনায়তনে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, অতি বয়স্করা ঘরের মধ্যে থাকবেন। প্রয়োজন না হলে বাইরে বের হবেন না। ভিড় এড়িয়ে চলুন এবং অপরিচিত কেউ যদি বাসায় আসে বা বাইরে থেকে কেউ এসেছেন এমন কারো কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
নিয়মিত সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোবেন, অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করবেন না। ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
শুধু কোভিক-১৯ এর জন্য ব্যাপারটি প্রযোজ্য নয়, বরং শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ রয়েছে তেমন ব্যক্তির সংস্পর্শও এড়িয়ে চলুন। শিষ্টাচার মেনে চলুন, অসুস্থ হলে ঘরে থাকুন। বাইরে যাওয়া যদি অত্যাবশ্যক হয়, সে ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার করুন, কারো সাথে করমর্দন, কোলাকুলি করা থেকে বিরত থাকুন।
তিনি বলেন, বিদেশ ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন, যারা দেশের বাইরে আছেন এখনো কয়েকটি এয়ারলাইন্স খোলা রয়েছে। যদিও বেশির ভাগ এয়ারলাইন্স বন্ধ। তারপরও যদি কেউ প্রয়োজন না হয়, বিদেশ থেকে আসার ব্যাপারে তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
এসময় মিরপুরের ৭৩ বছর বয়সি এক বাসিন্দা একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।
এছাড়া, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সিলেটে আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন এক নারীও মারা গেছেন।
যুক্তরাজ্যফেরত ওই নারীর মুখের লালাসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। কিন্তু এ দুজনের মৃত্যুর বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে কিছুই বলা হয়নি।
দেশের সব দোকান ও সুপারমার্কেট বন্ধ ঘোষণা : দেশের সুপারমার্কেটগুলোসহ সর্বপ্রকার দোকান বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার রাতে দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দোকানগুলো বন্ধ থাকবে। তবে কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খোলা থাকবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন, নিউ মার্কেটের মতো সুপারমার্কেটগুলো নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন থাকবে।
২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবো। তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান, কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান বা আগোরা, মীনা বাজার, স্বপ্নের মতো সুপারশপগুলো খোলা থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আতঙ্কের বিষয়টিকে পুঁজি করে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি। এরকম ঘটনা যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করতে আমরা এই পদক্ষেপ নিয়েছি।
পাশাপাশি করোনা ভাইরাস আতঙ্কে মার্কেটগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ায় এবং শ্রমিক, কর্মচারী ও মালিকদের মধ্যে এ ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা যেন না থাকে সেই লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর লকডাউন : মাদারীপুরের শিবচরের পর এবার লকডাউন করা হয়েছে গাইবান্ধার জেলার সাদুল্যাপুর উপজেলা। সাদুল্লাপুরের হবিবুল্লাপুরে দুই আমেরিকা প্রবাসী করোনা পজেটিভ শনাক্ত হওয়ায় গতকাল রোববার ওই উপজেলাকে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন সাদুল্যাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. নবীনেওয়াজ।
ইউএনওর এক আদেশে বলা হয়েছে, গাইবান্ধা জেলাধীন সাদুল্যাপুর উপজেলার ৯ নম্বর বনগ্রাম ইউনিয়নের হবিবুল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা কাজল মণ্ডলের বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাদের আমেরিকা প্রবাসী দুই আত্মীয় উপস্থিত ছিলেন।
তারা দুজনই করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ২১ মার্চ গাইবান্ধা-৩ (সাদুল্লাপুর-পলাশবাড়ী) আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে দাওয়াতপ্রাপ্ত অংসখ্য লোক ভোট দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
ফলে সাদুল্লাপুরে করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ফলে ওই এলাকার মানুষদের সুরক্ষার জন্য সাদুল্যাপুর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত : বিশজুড়ে করোনার প্রভাব দেশেও লেগেছে। ফলে শেষ পর্যন্ত দেশে আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
আগামী মাসের শুরুতে পরবর্তী তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে বলে নিশ্চিত করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়ের।
এদিকে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বাসায় বসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে। পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সূচি নির্ধারিত হবে।
আগামী মাসে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে : সিটি মেয়র
নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশের মানুষ যখন আতঙ্কিত তখন নতুন আরেকটি আতঙ্কের বার্তা দিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ মোহাম্মদ খোকন।
গতকাল রোববার তিনি বলেন, এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এ জন্য সবাইকে এখনি সতর্ক হতে হবে। প্রবাসীদের অবাধ বিচরণের কারণে করোনা ছড়িয়ে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।
প্রবাসীদের দেশে এসে অবাধ বিচরণের সুযোগ দেয়া ছিলো মারাত্মক ভুল। সিটি কর্পোরেশন এলাকার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি রিভিউ করে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা দরকার।
করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ ও এদের মাধ্যমে এটি যেনো আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য আক্রান্তদের নজরদারিতে রেখে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে।
একই সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে আগত সাধারণ রোগীরা যেনো চিকিৎসাসেবা পান এবং করোনা আক্রান্ত রোগীদের ছোঁয়ায় অন্যরা যেনো আক্রান্ত না হন সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালকদের সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার প্রতিনিধিদের এখনই বসা উচিত।
ঢাকা দক্ষিণে দোকান, রেস্টুরেন্ট ও চা-স্টল বন্ধের নির্দেশ : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান ছাড়া অন্যান্য সব দোকান-পাট বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)।
ডিএসসিসির এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা দক্ষিণে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, চায়ের দোকান, বেকারি, কনফেকশনারি, ফুচকা-চটপটিসহ ছোট-বড় সকল প্রকার খাবারের দোকান পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।’
তবে হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, ওষুধের দোকান, ব্যাংক-এটিএম বুথ, ফলের দোকান, মুদি দোকান, কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের দোকান, স্টেশনারি, হার্ডওয়্যার, মোবাইল-ফ্লেক্সিলোডের দোকান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান-পাট স্বাভাবিক সময় পর্যন্ত খোলা থাকবে। উল্লিখিত নির্দেশনাগুলো অমান্য করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে গণবিজ্ঞপ্তিতে।
স্থলপথেও বিদেশি নাগরিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশের সব স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশি নাগরিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গতকাল রোববার দেশের সব স্থলবন্দরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্গমন শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মনিরা হক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সমপ্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
এ জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে করোনা ভাইরাসের অধিকতর সংক্রমণ প্রতিরোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে রোববার থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের চালু সব স্থলবন্দর দিয়ে বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হলো।’
দেশে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা পোশাক তৈরির উদ্যোগ : করোনা রোগীদের সংস্পর্শে এসে অন্যরাও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। এ জন্য রোগীদের স্পর্শ করা যাবে না।
তবে চিকিৎসক কি রোগীকে স্পর্শ না করে চিকিৎসা দিতে পারবেন? নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাই চিকিৎসা কাজে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজন পর্যাপ্ত পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। সেটার পর্যাপ্ততা নেই দেশে।
ইতোমধ্যে চীন, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ অনুদান হিসেবে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে পিপিই নিয়ে দেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
এর মধ্যেই সুখবর দিলো যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। তারা দেশের সঙ্কটকালীন সময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঘোষণা দিয়েছে চার লাখ পিপিই বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এমঅ্যান্ডএসের ফিন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, যৌথভাবে পিপিইগুলো উৎপাদন করা হবে। এর সঙ্গে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সেগুলো হলো— এমঅ্যান্ডএস, পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ, অনেস্ট, বুয়েট অ্যালামনাই, ঢাকা সব রোটারি ক্লাবের পক্ষে ঢাকা নর্থ-ওয়েস্ট রোটারি ক্লাব। এ ছাড়া এমঅ্যান্ডএসের সাপ্লাইয়ার এফসিআই, তারা পিপিইর সেম্পল ডেভেলপমেন্ট করছে। এটি যৌথ উদ্যোগ। প্রাথমিকভাবে আমরা দুই-চার লাখ পিস উৎপাদন করবো।
তিনি বলেন, আমরা প্রথমে পে ইট ফরওয়ার্ড থেকে অনুরোধ পাই। উনারা চেয়েছিলেন এরকম কিছু করা যায় কি-না, তখন আমরা মনে মনে এটাই চিন্তা করছিলাম।
পরবর্তীতে আইডিয়া ডেভেলপ করা শুরু করছি। বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। তারাও কিছু পরিকল্পনা করেছে। সবাই মিলে ফান্ডিং যোগার করা হয়েছে। আমরাও তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পিপিই তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সব বিমানবন্দর শাটডাউনের পথে : দেশের পরিস্থিতি দিনে দিনে অবনতির পথে। ফলে যেকোনো সময় দেশের সব বিমানবন্দরে শাটডাউনের ঘোষণা আসতে পারে। নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ওঠা-নামায়।
এই সিদ্ধান্ত নিতে গত দুইদিন ধরে কঠোর মনিটরিং করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আজ থেকে ১০ দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বেবিচক। বর্তমানে শুধু থাইল্যান্ড, চীন, যুক্তরাজ্য ও হংকংয়ের সঙ্গে বিমান চলাচল রয়েছে বাংলাদেশের।
তবে এই চার দেশের ফ্লাইট চলাচলেও নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েছে বেবিচক। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে এসব দেশেও বিমান চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে সংস্থাটি।
চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতদের সুরক্ষায় দ্রুত উপকরণ সরবরাহের নির্দেশ : করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়জিত দেশের চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে, করোনা প্রতিরোধে কী কী উপকরণ দরকার সেটি নির্ধারণ করতে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী কালের মধ্যে ওই কমিটিকে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল রোববার এসব নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদের পক্ষে আইনজীবী এখলাছ উদ্দিন ভূঁইয়াসহ তিন আইনজীবী।
রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরে হাইকোর্টের বিচারপতি আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
ওই কমিটির সদস্য হবেন, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, আইইডিসিআরের পরিচালক ও সেন্ট্রাল মেডিসিন স্টোরের পরিচালক। ওই তালিকা বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
জামিন ছাড়া নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজ মুলতবি, আসতে পারে উচ্চ আদালত বন্ধের সিদ্ধান্ত : করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা দেশের নিম্ন আদালতের কার্যক্রমও সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আলী আকবর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জামিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া দেশের নিম্ন আদালতের বিচারিক কাজ মুলতবির নির্দেশনা এলো। মূলত নিম্ন আদালতগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম হয়। ফলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকি এড়াতে সর্বোচ্চ আদালত থেকে এ সিদ্ধান্ত এলো।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলের সাক্ষাৎ— করোনা ভাইরাসের কারণে ‘আদালত বন্ধ হবে কি-না’ সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে গতকাল রোববার দুপুরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির খাসকামরায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক থেকে বের হয়ে মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ সংকটময় মুহূর্তে আদালত বন্ধের বিষয়ে প্রধান বিচারপতিকে পরামর্শ দিয়েছি।
তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগ কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে— সেগুলো দেখে আদালত বন্ধ হবে কি-না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কোর্টেও আইনজীবীরও চাইছেন এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ ঘোষণা দিক।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৬৩ নাগরিকের ১০ দাবি : করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন ৬৩জন সচেতন নাগরিক। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা গণমাধ্যমে এই চিঠি পাঠিয়েছেন।
এতে বলা হয়— ১. আমরা চাই, সরকার আর কালক্ষেপণ না করে শ্বেতপত্রের মাধ্যমে করোনা মহামারি রোধের পরিকল্পনা ও কার্যকর প্রণালী জনসমক্ষে প্রকাশ করবে।
শ্বেতপত্রে থাকবে ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কতজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন এবং তাদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম কবে পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে সর্বোচ্চ কতটি বেড প্রস্তুত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে কতটি ভেন্টিলেটর প্রস্তুত আছে, করোনা পরীক্ষার কতগুলো কিট আছে, প্রতিদিনের ব্যবহারের মানসম্মত গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদির মজুত কতদিনের মধ্যে নিশ্চিত করা যাবে, এসব তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
২. অবিলম্বে দেশের সব জায়গায় বিনামূল্যে টেস্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় কিটসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ ও তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কিট তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে দ্রুত খালাস ও কর মওকুফের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. দেশের সব প্রবেশপথ সতর্ক নজরদারির আওতায় নিতে হবে। অবিলম্বে করোনা সংক্রমণের সময় আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য বা ইতোমধ্যে আক্রান্ত অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করতে হবে। গুরুত্ব অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের ভেতর কক্সবাজার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পর্যটন গন্তব্যগুলো বন্ধ করে দিতে হবে।
৪. কোয়ারেন্টাইনের জন্যে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে বড় হোটেল-মোটেল-রিসোর্টসহ উপযোগী ভবনগুলো অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, খালি ভবনে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা সম্ভব। সিএমএইচ ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সমন্বিত পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে।
৫. ডাক্তার-নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপদ পোশাক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্যে দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। দেশের পোশাক কারখানা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্যে পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহ করতে হবে।
৬. গণপরিবহন ও গণপরিসরগুলো এবং সংক্রমণের হটস্পট নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলখানার ঝুঁকিপূর্ণ জনচাপ দূর করে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, জনচাপ কমাতে বিনা বিচারে আটক, মেয়াদ উত্তীর্ণদের মুক্তি দিতে হবে। ছিন্নমূল, ভাসমান মানুষদের জন্যে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় শিবির খুলে তাদেরকে সরিয়ে নিতে হবে।
গাদাগাদিভাবে বাস করা বস্তিবাসীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি বস্তিতে পরিচ্ছন্নতার উপকরণ সরবরাহ এবং করোনা মনিটরিং সেল স্থাপন করতে হবে। রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রেও একই রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করবার জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. করোনা সংক্রান্ত জরুরি কাজ ছাড়া পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আপদকালীন সময়ে সবেতন ছুটি দিতে হবে। ছুটিকালীন শ্রমিকদের মজুরি যাতে ঠিকমতো পরিশোধ হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুতদারি বন্ধ করে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্ন আয়ের এবং রোজগার হারানো মানুষদের জন্যে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সুযোগে ঋণখেলাপি, চোরাই টাকার মালিকদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া যাবে না।
৯. বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী, ধর্মীয় নেতাদের সাহায্যে পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় ক্লাব, সংগঠন ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম দিয়ে তাদের প্রচার ও রোগ প্রতিরোধে কাজের সুযোগ দিতে হবে।
১০. এর পাশাপাশি ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া মোকাবিলায় সরকারের কী পরিকল্পনা তা প্রকাশ করতে হবে। বর্ষা আসার আগেই আমাদের ডেঙ্গু মৃত্যু রোধ করবার প্রস্তুতিও শেষ করতে হবে, যেটি একই কমিটি থেকে পরিচালিত হতে পারে।
আমারসংবাদ/এসটিএমএ