Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

এলাকাছাড়া সাবেক এমপিরা

প্রিন্ট সংস্করণ॥আসাদুজ্জামান আজম

আগস্ট ১৯, ২০১৯, ০৮:৩৫ পিএম


এলাকাছাড়া সাবেক এমপিরা

গেলো বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসেও তিনি ছিলেন ত্রাণকর্তা। নির্বাচনি এলাকার রাস্তার প্রতিটি মোড়, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ওয়ার্ড এমনকি বাড়ি-বাড়িতে মিলতো এমপির ছবিসংবলিত বিশাল আকৃতির ব্যানার-ফেস্টুন।

প্রশাসন ও দলীয় নেতাকর্মীরা তটস্থ থাকতেন নেতার নির্দেশনা বাস্তবায়নে। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। তালিকা প্রকাশ পাবার পরপরই পাল্টে যায় দেশের প্রায় ৭০টি নির্বাচনি এলাকার দৃশ্যপট।

নিমিষেই রাজত্ব হাতছাড়া হয়ে যায় তৎকালীন সাংসদের। সেই যে হাতছাড়া, এরপর ওই এলাকায় তিনি হয়ে গেছেন পরগাছা। তার না আছে নেতাকর্মী না আছে পোস্টার ব্যানার। কার্যত এমন দৃশ্যই এখন নতুন সংসদে আসা অন্তত ৩০টি সংসদীয় আসন ঘিরে।

তথ্য মতে, স্থানীয় রাজনীতির ত্রাণকর্তা ওই আসনের সাংসদ। সাংসদ পদে পরিবর্তন আসার সঙ্গে গোটা এলাকার রূপ পাল্টে যায়। সরকারি দপ্তরসহ দলের জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড— সব কমিটিতে তার একক কর্তৃত্ব।

জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ সব নির্বাচনেই সাংসদপন্থিরাই মনোনয়ন ও নির্বাচিত হন। কোনো কারণে সাংসদ পদে পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে ওই এলাকার রাজনীতিতে।

আর অতীতে যারা এমপির মনোনয়নের বিরোধিতা করেছিলেন অনিশ্চয়তায় পড়ে তাদের রাজনীতি। দল বা সরকারি কর্মকাণ্ডে কোথাও তাদের অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। দলসহ সরকারের সুযোগ-সুবিধার সুফল পেয়ে থাকে এমপির পছন্দীয় লোকজন।

গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ৫৮টির মতো আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নতুন মুখ। নির্বাচনের পর এসব আসনের মধ্যে অন্তত ৩০টির মতো আসনে পাল্টে গেছে রাজনীতির হালচাল।

বর্তমান সাংসদ ও অনুসারীদের দাপটে এলাকাছাড়া সাবেক সাংসদ। এলাকায় ঢুকতে পারেননি সাবেক ওই সাংসদের অনুসারীরাও। যারা এলাকায় আছেন- পদ থাকলেও তারা রাজনীতিতে কোণঠাসা। দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তারা আমন্ত্রণ কিংবা অংশ নিতে পারেন না।

শরীয়তপুর-১ (পালং-জাজিরা) আসনে গত নবম ও দশম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক। গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন পান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা ইকবাল হোসেন অপু।

মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই এলাকাছাড়া সাবেক এমপি মোজাম্মেল হক। তিনি গত আট মাসে একবারের জন্য এলাকায় যাননি। দলীয় কোনো কর্মসূচিতেও তিনি শরীয়তপুর আসেননি। তার অনুসারীও অনেকে এলাকাছাড়া।

অন্যদিকে, সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই গোটা এলাকা ইকবাল হোসেন অপুর নিয়ন্ত্রণে। অপুর অনুসারীদের দাপটে মোজাম্মেল অনুসারীরা গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওই এলাকায় বিএম মোজাম্মেল কখনো সাংসদ ছিলেন, সেটা মনে হওয়ার উপায় নেই।

কিছুটা ভিন্ন রূপ জেলার আরেকটি আসন শরীয়তপুর-২ (নড়িয়া) আসনে। আসনটি থেকে গত ছয়টি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন কর্নেল (অব.) শওকত আলী।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে আসনটি থেকে সাংসদ হয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম।

সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা মনোনয়ন পাওয়ার পরপরই শওকত আলীর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার অনুসারীরা অনেকেই শামীমের সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, আবার অনেকেই নিষ্ক্রিয়।

নির্বাচনের পর শওকত আলী দুবার এলাকায় এলেও পারিবারিকভাবে সময় কাটিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। কোনো দলীয় কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেননি এবং তাকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি।

জানতে চাইলে শরীয়তপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ বিএম মোজাম্মেল হক বলেন, নির্বাচনের পর এলাকায় যাওয়ার পরিবেশ ছিল না। আমার নেতাকর্মীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আগামী কিছু দিনের মধ্যে এলাকায় আসা-যাওয়া শুরু করবো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে বর্তমান সাংসদ ব্যবসায়ী এবাদুল করিম বুলবুল। গত দশম সংসদে আসনটি থেকে সাংসদ হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ব্যবসায়ী ফয়জুর রহমান বাদল।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর এলাকায় যান না সাবেক এ সাংসদ। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও কোনো দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেননি। এমনকি আগস্টের মাসব্যাপাী কর্মসূচিতেও এলাকায় আসেননি একটিবার।

কুমিল্লা-৮ আসন থেকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সাংসদ হয়েছেন নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে নিজের মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেন। নির্বাচনের পর এমপির নির্দেশে নৌকার পক্ষে কাজ করায় ৬৫ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন বলে জানা গেছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদারব ও শেরে বাংলানগর নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩ আসনে প্রথমবারের মতো সাংসদ হয়েছেন উত্তর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান।

এ আসনে দশম জাতীয় সংসদে নৌকা মনোনয়নে এমপি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। সাংসদ পদ হারানোর পর গোটা এলাকায় নানক অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

নানকও স্থানীয় রাজনীতিতে অনুপস্থিত। একাদশ সংসদে পটুয়াখালী-৩ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার ভাগনে এসএম শাহজাদা সাজু।

এর আগে তিনি কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটির আওয়ামী লীগের সাবেক সাবেক সাংসদ আখম জাহাঙ্গীর হোসেন এলাকায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।

সাবেক সাংসদ আখম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি দীর্ঘ ৮ মাস ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ। নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছি। যে কারণে এলাকায় কম যাওয়া হচ্ছে। গত দুই ঈদে গিয়েছি। এখন অনেকটা সুস্থ আগামীতে যাওয়া-আসা নিয়মিত হবে ইনশাল্লাহ।

চাঁদপুর-২ আসনে প্রথমবারের মতো এবারই সাংসদ হয়েছেন মো. নুরুল আমিন রুহুল। আসনটিতে একাধিকবার সাংসদ হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন মায়া।

মো. নুরুল আমিন সাংসদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধস নেমেছে মায়ার দুর্গে। এক সময়ের দাপুটে নেতা মায়ার উপস্থিতি এখন গোটা এলাকাজুড়ে নিষ্ক্রিয়। নির্বাচনের পর দুবার এলাকায় গেলেও নিজ বাড়ি থেকেই ঢাকায় ফিরেছেন। একই অবস্থা চাঁদপুর-৪ আসনজুড়ে।

গত জাতীয় নির্বাচনে খুলনা-২ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছেন শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েল। মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর এলাকায় কোণঠাসা সাবেক এমপি মিজানুর রহমানের অনুসারীরা।

বাগেরহাট-২ আসন থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময় সংসদ সদস্য হয়েছেন। ওই আসনটির সাবেক সাংসদ মীর শওকত আলী বাদশার অনুসারীরা প্রায় সকলেই শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের সঙ্গে রয়েছেন।

নড়াইল-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে সাংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা। এ আসনটির সাবেক সাংসদ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ হাফিজুর রহমান। জোটের রাজনীতিতে তিনি নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে এলাকায় নিষ্ক্রিয়। কুষ্টিয়া-১ ও ২ আসনের সাবেক সাংসদ যথাক্রমে রেজাউল হক চৌধুরী ও আব্দুর রব দুজনেই এলাকায় আসা-যাওয়া করলেও দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয়।

নওগাঁ-৫ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের ছেলে নিজাম উদ্দিন জলিল জন। আসনটির সাবেক সাংসদ আব্দুল মালেক এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছেন। গোটা এলাকায় কোথাও তার একটি ফেস্টুনও মেলানো দায়।

মাদারীপুর-৩ আসনে গত মেয়াদে সাংসদ ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাসিম। একাদশ সংসদে আসনটিতে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ। নির্বাচনের পর থেকেই আসনটিতে তেমন একটা আসেন না বাহাউদ্দিন নাসিম। তার অনুসারীরাও রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।

মাগুরা-১ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস অ্যাডভোকেট সাইফুজ্জামান শিখর। আসনটির সাবেক সাংসদ এটিএম আব্দুল ওহাব এলাকা ছেড়েছেন মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পরই।

পি?ওরাজপুর-১ থেকে আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিম। আসনটির সাবেক এমপি আব্দুল আউয়াল এলাকায় অবস্থান করলেও মন্ত্রীর সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে এবং তার নেতাকর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফরিদপুর-১ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক সচিব মনজুর হোসেন। আসনটির সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান। মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকে কয়েকবার এলাকায় এলেও স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি।

এছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ-২ সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ, মেহেরপুর-২ সাহিদুজ্জামান, নাটোর-১ শহীদুল ইসলাম বকুল, জামালপুর-৪ আসনে ডা. মুরাদ হাসান, জামালপুর-৫ ইঞ্জিনিয়ার মোজাফ্ফর হোসেন, সিলেট-৫ হাফিজ আহমদ মজুমদার, পটুয়াখালী-৪ আওয়ামী লীগ নেতা মহিবুর বরহমান মহিব, টাঙ্গাইল-২ তানভীর হাসান ছোট মনির, টাঙ্গাইল-৬ আহসানুল ইসলাম টিটু, টাঙ্গাইল-৮ অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম ভিপি জোয়াহের, পাবনা-২ আহমেদ ফিরোজ কবির, ব?রিশাল-২ মো. শাহে আলম ও বরিশাল-৫ ক?র্নেল (অব.) জা?হিদ ফারুক শামীম, যশোর-২ মেজর জেনারেল (অব.) মো. নাসির উদ্দিন, ঝিনাইদহ-৩ শফিকুল আজম খান চঞ্চল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ ডা. সামিল উদ্দিন, নেত্রকোনা-১ মানু মজুমদার ও নেত্রকোনা-৩ অসীম কুমার উকিল, মৌলভীবাজার-৩ নেছার আহমদ, হবিগঞ্জ-১ শাহ নেওয়াজ মিলাদ গাজী, ময়মনসিংহ-১১ কাজিম উদ্দিন আহমেদ ধনু, নরসিংদী-২ ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খাঁন দিলীপ, রাজশাহী-৫ ডা. মনসুর রহমান, সিরাজগঞ্জ-৩ জাতীয় শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. আব্দুল আজিজ। এসব আসনের সাবেক সাংসদ ও অনুসারীরা স্থানীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন।