Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪,

চার বছরেও হয়নি বিচার

প্রিন্ট সংস্করণ॥আব্দুল লতিফ রানা

সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯, ০৮:৪৬ পিএম


চার বছরেও হয়নি বিচার

পুরান ঢাকার হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলে ‘বোমাহামলা’ মামলার সাক্ষী হাজির না হওয়ায় বিচারকাজ শেষ হচ্ছে না। চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির বিচারকাজ ‘সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল’ আদালতে চলছে।

আদালত সূত্র জানায়, বোমাহামলার মামলার চার্জশিটে ৪৬ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এখনো ৩৫ জন সাক্ষী আদালতে উপস্থিত হননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই মামলার সাক্ষীদের খুঁজে পাচ্ছে না। আদালতে সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত শেষ করা যাচ্ছে না।

সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালতে বোমাহামলা মামলার বিচারকাজ চলছে। গতকাল সোমবার মামলার সাক্ষী হাজিরার দিন ধার্য্য ছিলো, কিন্তু কোনো সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আগামী ২৪ অক্টোবর পুনরায় সাক্ষী হাজিরের দিন ধার্য্য করা হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ২২ অক্টোবর সাক্ষী হাজিরের দিন ধার্য্য ছিলো। ওইদিন আবু সাঈদ নামে এক সাক্ষী আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের (আদালত) পিপি জাহাঙ্গীর আলম জানান, গতকাল মামলার সাক্ষী হাজিরের তারিখ ছিলো। একজন সাক্ষী হাজিরও হয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের জজ অসুস্থ থাকার কারণে শুনানি করা হয়নি।

উক্ত মামলার ২ নম্বর সাক্ষী সৈয়দ মাজেদ হোসেন। চকবাজার থানার হোসেনি দালানে তার ঠিকানায় গিয়েও খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর সানোয়ার হোসেন সানু নামে ৭ নম্বর সাক্ষী। লালবাগ থানার নতুন পল্টনস্থ ঠিকানায় গিয়ে তারও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। আর ৮ নম্বর সাক্ষী একরাম হোসেনের ঠিকানা দেয়া আছে লক্ষ্মীপুরে।

১৩ নম্বর সাক্ষীর ঠিকানা হচ্ছে মাদারীপুরে। আর ১৬ নম্বর সাক্ষী হচ্ছেন নাসির উদ্দিন। তার ঠিকানা দেয়া হয়েছে আরমানিটোলা। এছাড়া মো. জামাল উদ্দিন চকবাজার থানার সিরাজ উদ্দিন রোডে তার ঠিকানা দেয়া হয়েছে। মামলার এসব সাক্ষীদের ঠিকানায় গিয়ে তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চাঞ্চল্যকর এই মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর ১০ সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেছেন আদালত।

তৎকালীন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কামরুল হোসেন মোল্লার আদালতে উক্ত চার্জশিটটি গ্রহণ করেন। এরপর একই বছরের ৬ মার্চ আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন শুনানির জন্য দিন ধার্য্য করেন।

২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে মধ্যরাতে জেএমবির সদস্যরা হোসেনি দালানে বোমাহামলা চালায়। এতে দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

ওই বোমাহামলার ঘটনায় চকবাজার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক জালাল উদ্দিন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় কবির হোসেন, মাসুদ রানা, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাসুদ, আবু সাঈদ সোলেমান, শাহ জালাল, ওমর ফারুক, চাঁন মিয়া, রুবেল, আরমান ও জাহিদ হাসানসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়।

এরপর গত ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা মহানগর হাকিম আব্দুল্লাহ আল মাসুদের আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শফিউদ্দিন ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটের সবাই জেএমবির সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

চার্জশটিভুক্ত আসামরাি হলেন— সাঈদ ওরফে হরিন ওরফে কামাল, জাহদি হাসান ওরফে রানা ওরফে মোসায়েব, শাহাদাত ওরফে আলবানি ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা, আবদুল বাকি ওরফে আলাউদ্দিন ওরফে নোমান, আরমান, রুলে ইসলাম ওরফে সজীব, কবির হোসনে ওরফে রাশেদ ওরফে আশিক, মাসুদ রানা, আহসান উল্লাহ মাহমুদ, আবু সাইদ সোলায়মান ওরফে সালমান, চান মিয়া, ওমর ফারুক ওরফে মানিক ও শাহজালাল। শিয়া সমপ্রদায়ের বড় সমাবশেস্থলে বহু সংখ্যক মানুষ হত্যার পরকিল্পনা নিয়েছিল জঙ্গিরা।

কিন্তু হোসেনি দালানের চারপাশে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বা সিসিটিভি পুলিশের আর্চওয়ে স্থাপনসহ অতিরিক্ত নিরাপত্তার কারণে জঙ্গিরা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ওই হামলায় নব্য জেএমবরি ১৩ জঙ্গি অংশ নিয়েছিল। আর তৎকালীন নব্য জেএমবির সংগঠনটির ও সামরিক শাখার কমান্ডার শাহাদাত ওরফে আলবানি ওরফে মাহফুজ ওরফে হোজ্জা ছিলেন হামলার প্রধান পরকিল্পনাকারী।

পরিকল্পনাকারীসহ তিনজন বিভিন্ন সময়ে ডিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আর বাকি ১০ জন এখনো কারাগারে রয়েছেন। এই ১০ জনের মধ্যে পাঁচজন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সূত্র আরও জানায়, প্রথমে জঙ্গিরা মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে শিয়াদের ওপর হামলার পরিকল্পনা নিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল। পরে হোসেনি দালানে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কামাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া নেয়।

হোসেনি দালানের কবরস্থান থেকে জঙ্গি মাহফুজ ওরফে আলবানি পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করে। এ সময় তার সঙ্গে রাশেদ ওরফে আশিক উপস্থিত ছিল। আর তিনজন আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির পর পীর ও মাজারের অনুসারীদের হত্যায়ও অংশ নিয়েছিল। সাভারের কমার্স ব্যাংকে ডাকাতিসহ আটজনকে হত্যার ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল এই জঙ্গি হোজ্জা।

পুলিশ জানায়, হোসেনি দালানে বোমাহামলার পর হাজারীবাগ এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় জেএমবির দুই কমান্ডার হরিন ওরফে কামাল ও আলাউদ্দিন ওরফে নোমান।

তার আগে গাবতলী এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে অপর এক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় মাহফুজ ওরফে হোজ্জা নিহত হয়। আর তিন জঙ্গিই হোসেনি দালানে বোমাহামলা, গাবতলী ও আশুলিয়ায় পুলিশ সদস্য হত্যায় জড়িত।

মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজিরের বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, তদন্তের পর এই মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। আর আদালতের নির্দেশ পেলে সাক্ষীদের হাজির করা হবে বলে জানান তিনি। ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে আসা সকলকে তল্লাশি করা হবে বলে জানিয়েছেন। গত শনিবার হোসেনি দালানের ইমামবাড়া এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি এ কথা জানান। ডিএমপি কমিশনার বলেন, আশুরার মিছিলে শুরু থেকে অংশগ্রহণ করতে হবে।

মিছিল চলাকালে মাঝপথে কোনো অলিগলি থেকে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যারা মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন শুরুতেই সবাইকে তল্লাশি শেষে মিছিলে অংশ নিতে সুযোগ দেয়া হবে। আশুরাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হোসেনি দালান ইমামবাড়া, মিরপুর, বড় কাটারা, ছোট কাটারা ও মোহাম্মদপুর এলাকায় মহররমের ছয় থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

গতকাল ইমামবাড়া গিয়ে দেখা গেছে, পুরো এলাকা সিসিটিভি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা হোসেনি দালানে প্রবেশ করছেন, তাদের প্রত্যেককে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। আবার ইমামবাড়ার চারপাশে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ (এসবি) এবং গোয়েন্দাদের নজরদারিও চলছে।

ডিএমপি কমিশনার বলেছেন, অনুষ্ঠানের আগে ডগ স্কোয়াড দিয়ে পুরো এলাকা সুইপিং করা হবে। অনুষ্ঠানগুলো মনিটর করবে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকবে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ও সোয়াত টিম।

এছাড়া মহররমের মিছিলে ধাতব বস্তু, ছুরি, তরবারি ও বর্শা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া মিছিলে কোনো বস্তু বহন ও ১২ ফুটের বেশি উচ্চতার নিশান বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আবার পাঞ্জা মেলানো, শক্তির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মিছিলে উচ্চশব্দে যেকোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।