Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪,

দানে সরব প্রত্যাবাসনে চুপ

আবদুর রহিম

অক্টোবর ১৯, ২০২০, ০৬:১০ পিএম


দানে সরব প্রত্যাবাসনে চুপ

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় রোহিঙ্গাদের দান করতে সরব থাকলেও প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চুপ! রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘায়িত ভাবনা বাড়ছে। বাংলাদেশকে অযৌক্তিকভাবে মিয়ানমার দোষারোপ করলেও কেউ মুখ খুলছে না। বিভিন্ন দেশে থাকা লাখ লাখ মিয়ানমারের নাগরিককে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি ও নয়া ষড়যন্ত্র চলছে।

দেশের অনিশ্চয়তায় অন্ধকারের ইঙ্গিত। শুধু গত তিন বছরে প্রায় এক লাখ শিশু বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছে। ওদের পরিচয় কী তাও কেউ জানেন না। দেশি-বিদেশি সহায়তা নিয়ে আরাম-আয়েশেই দিন কাটাচ্ছে রোহিঙ্গারা।

ফ্রিতে খাচ্ছে, থাকছে। স্থানীয় অধিবাসীদের তুলনায় রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কক্সবাজারের আশপাশ এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। খুনের ঘটনাও ঘটছে।

শৃঙ্খলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলো রোহিঙ্গাভারে বিপর্যস্ত। আশ্রিত এসব রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সন্ত্রাসী তৎপরতাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত।

মানব ও মাদকপাচারের পাশাপাশি বহু রোহিঙ্গা সদস্য এদেশের আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ১৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বর্তমান পরিস্থিতি নাজুক। ৩৪ শিবিরে বাড়ছে বিপদ।

 এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানোর আলোচনার দরজা যেন দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ১০ বছরের জন্য সহায়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দাতারা। এনজিও, দাতা ও বিভিন্ন রাষ্ট্র যতটা দান করতে আগ্রহী ততটা দূরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে।

এছাড়া ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের না পাঠাতে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।বিশ্বের শক্তিধর কয়েকটি রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাসমূহ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে বর্তমান সময়ে প্রাধান্য না দিয়ে তাদের জন্য আগামী ১০ বছরের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে এ ঘটনাকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করা হচ্ছে। সঙ্গে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হচ্ছে।

কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের পাশে আছে। তবে কার্যত সমাধানে চুপ! ভূমিকা অদৃশ্য। এ নিয়ে পেছনে রহস্য তৈরি হচ্ছে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার, কানাডিয়ান হাইকমিশনের মানবিক সহায়তা প্রধান, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের মতো বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিরা সমপ্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। এরপরও আসেনি কোনো সমাধান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃহৎ শক্তি ও দাতারা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে পেছনে ফেলে রেখে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা হিসেবে আগামী ১০ বছরের জন্য কর্মসূচি গ্রহণের তৎপরতায় নেমেছে।

আগামী ২২ অক্টোবর এ সংক্রান্ত ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ। এর পাশাপাশি চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠকেরও আয়োজন হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন, দাতারা ফেইজওয়াইজ আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপে তৎপর। দাতারা আরও বলেছে, মাল্টিইয়ার প্ল্যানিং নিয়ে। কিন্তু এ ধরনের প্ল্যানিংয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা থাকবে না বলে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন আরও স্কষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য মানবিক সহায়তা নয়, প্রত্যাবাসন।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার তিন বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। শুরুর দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক বলে জানিয়ে দুই দফায় দিনক্ষণ ধার্য করে।

কিন্তু মিয়ানমারের এ পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ লোক দেখানো। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যথাযথ পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে আওয়াজ ওঠে আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এরপর কিছুদিন চলে তালিকা চালাচালি।

বাংলাদেশের পক্ষে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দফায় দফায় তালিকা প্রেরণ করা হয়। মিয়ানমার পক্ষ সেখান থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গা তাদের নয় বলে জানান দেয়। বাংলাদেশ পক্ষ যতই তৎপরতা দেখায় বিপরীতে মিয়ানমার ততই পিছিয়ে যায়। বারবার জানান দিতে থাকে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়।

নাগরিকত্বের সনদ ছাড়া তারা কাউকে ফেরত নেবে না। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলায় প্রাথমিক নির্দেশনা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে প্রতীয়মান এতে মিয়ানমারের তেমন কিছু আসে যায় না।

এর মধ্যে আসছে নয়া চাপ ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা, অন্যদিকে ২২ লাখ বাংলাদেশি। পাসপোর্ট না দিলে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে সৌদি আরব। ধারণা করা হচ্ছে, বিষয়টির সঙ্গে সৌদি প্রবাসী ২২ লাখ বাংলাদেশির ভাগ্যও জড়িয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের ভাষ্য, ‘সৌদি আরব তো জানে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মিয়ানমারকে বলা উচিত। আমরা সৌদি আরবকে বলেছি, তোমরা আগে মিয়ানমারকে বলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘৩০-৪০ বছর আগে সৌদি বাদশাহ যখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় তখন অনেক রোহিঙ্গা সেখানে যায়। তখন অনেকের পাসপোর্ট ছিলো না। তারা ছিলো রাষ্ট্রহীন নাগরিক।

এ বিষয়ে অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘এটা তাদের একটা অন্যায় আবদার। তারা (রোহিঙ্গা) তো বিদেশি নাগরিক। তাদের পাসপোর্ট দিতে বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে। বাংলাদেশের উচিত তীব্র প্রতিবাদ জানানো এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া’।

বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলে বলছেন, প্রতিবছর ৩০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তিন বছরে প্রায় এক লাখ। এসব শিশুর কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে বাংলাদেশে?

রোহিঙ্গাদের পুরো একটি প্রজন্ম বাংলাদেশে বেড়ে উঠছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ ছাড়াই। এই যে পুরো একটি প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যৎ কী? বাংলাদেশ তাদের শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে না, দিচ্ছে না চাকরির সুযোগ।

কেননা এসব দিলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি ক্রমশ হারিয়ে যাবে। বরং বাংলাদেশের মূলস্রোতে মিশে যাবে তারা। ফলে বাংলাদেশের উদ্বেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্মকে বিপথে নেয়া কঠিন কিছু না। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকিও এড়ানোর মতো নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সময় আমাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

দেশটিতে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকার, সামরিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এক কাতারে রয়েছে। তাই বন্ধু দেশগুলোর সহযোগিতার পাশাপাশি এ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের কূটনৈতিক নাটক করেছে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরও মিয়ানমার নানান নাটক করেছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আন্তরিক নয়।

তিনি বলেন, ‘দুই দফার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত, যাতে করে মিয়ানমারের ফাঁদে আমরা আটকে না যাই।’ এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও রোহিঙ্গাদের সহায়তার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন নিয়ে চাপ থাকা উচিত।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের না পাঠাতে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে বলে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের ওপর চাপ রয়েছে, ইউএনএইচসিআর এবং অন্যান্য এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না পাঠানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ রয়েছে।’

আমারসংবাদ/এসটিএম