Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪,

প্রমাণ হলেও শাস্তি হয় না

আসাদুজ্জামান আজম

আগস্ট ৬, ২০২০, ০৬:৩৮ পিএম


প্রমাণ হলেও শাস্তি হয় না

পাঁচ বছর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘুরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা স্বামীর অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নির্যাতনের বিচার না পেয়ে গত বছরের ১৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর দারস্থ হন সালমা বেগম। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের এই অভিযোগ আমলে নিয়ে জনপ্রশাসন সচিবকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

এরপর প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপরও তাকে প্রাথমিক কোনো শাস্তি না দিয়ে বহাল রেখেছে জনপ্রশাসন মন্ত্র্রণালয়। ফলে জনপ্রশাসনের এই মামলায় প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন এমন অভিযোগ ওই স্ত্রীর।

ভুক্তভোগী সালমা আক্তার জানান, ২০১২ সালে সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আবু জাফর রাশেদ। দুই মেয়েসহ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সেখানে কর্মরত থাকাকালে অপর এক বিবাহিত নারীর সাথে তিনি অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। স্ত্রী এর প্রতিবাদ করলে তার ওপর অমানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকেন।

এরপর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ দুই মেয়েসহ স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এটি সহ্য করতে না পেরে ৩০ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন সালমা। ওই বছরের ১৪ অক্টোবর একই অভিযোগ করেন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ওই নারীর স্বামীও।

এসময় ৮ এপ্রিল আবু জাফর রাশেদকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ১২ মে ২০১৪ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অভিযুক্তের স্ত্রী এবং অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানো নারীর স্বামীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত প্রমাণ উপস্থাপন করার পরও অভিযুক্ত আবু জাফর রাশেদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

এরপর গত বছরের ২৭ এপ্রিল কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব (উপসচিব) পদে পদোন্নতি পান তিনি।  মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নামে নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ জমা হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এসব অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব একই ক্যাডারের সিনিয়র ব্যাচের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে না।

এরপরও যে দু-একটি ঘটনা তদন্তে প্রমাণ হচ্ছে নানা তদবিরের কারণে সেই অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফলে দায়িত্বে বহাল থেকে প্রভাব খাটিয়ে তদবিরের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করছেন।

ফলে শাস্তি না হওয়ায় কর্মকর্তাদের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বেড়েই চলেছে। যদিও চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, ‘কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের প্রস্তাব বা বিভাগীয় কার্যধারা রুজু হইলে, সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অভিযোগের মাত্রা ও প্রকৃতি, অভিযুক্ত কর্মচারীকে তাহার দায়িত্ব থেকে বিরত রাখিবার আবশ্যকতা, তৎকর্তৃক তদন্ত কার্যে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা ইত্যাদি বিবেচনা করিয়া তাহাকে সাময়িক বরখাস্ত করিতে পারিবেন।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রশাসনের দুই হাজার ৭৪৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এসব অভিযোগ তদন্ত করে মাত্র ৩৬৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক সত্যতা পায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এরপর প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিধিমালার আলোকে ৩৬৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। এর আগেসহ এ নিয়ে সর্বমোট ৪৪০টি বিভাগীয় মামলার মধ্যে গত ১০ বছরে ৬৭ জন কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড, ১২৬ জন কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড, ২০৩ জন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

ব্যাচমেটের সঙ্গে পরকীয়া, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব না নেয়ার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার পরও দায়িত্বে বহাল আছেন হাতিয়ার এসিল্যান্ড সারোয়ার সালাম। প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুরোধে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের করা তদন্তে এই অভিযোগগুলো প্রমাণিত।

তবুও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সারোয়ারের স্ত্রী খাদিজা আক্তার কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার পাচ্ছেন না। তার অভিযোগ— গুটিকয়েক প্রভাবশালী কর্মকর্তার কারণেই সারোয়ার সালামের শাস্তি হচ্ছে না।

সচিবালয় সূত্র জানায়, সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগগুলো হলো— স্ত্রী সন্তানের অধিকার বঞ্চিত করা, স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক এবং তালাক দেয়ার হুমকি।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গত ২৫ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

মন্ত্রিপরিষদের চিঠির পরও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ উঠলে তাদের ওএসডি করা হয়।

কিন্তু সারোয়ারকে ওএসডি না করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুর থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ায় এসিল্যান্ড হিসেবে বদলি করা হয়েছে। এতে প্রশাসনের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেই মনে করেন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, খাদিজা আকতার তার স্বামীর নামে ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার এবং ২০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের সঙ্গে নির্যাতনের বিভিন্ন ছবি এবং ফোন কলের অডিও রেকর্ডের ক্লিপও জমা দেন খাদিজা। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে ১৯ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন আরাফাত। এই কমিটি সারোয়ারের বিরুদ্ধে করা স্ত্রী খাদিজার ছয়টি অভিযোগের মধ্যে চারটির প্রমাণ পায়।

সারোয়ার সালামের কয়েকজন সহকর্মীও তাদের বক্তব্যে বলেছেন, সারোয়ারের সঙ্গে তারই এক ব্যাচমেটের সখ্যতাটা বেশি ছিলো। দুজনের আচরণ তাদের কাছে যথেষ্ট সন্দেহজনক ছিলো।

তারা ফেনীতে থাকাকালীন একই ডরমিটরির একই তলায় পাশাপাশি রুমে থাকতেন। ফলে তারা দিনরাত দুজন দুজনের রুমে অবাধে যাতায়াত করতেন। এটি তাদের অন্য সহকর্মীদের চোখেও পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের চাপে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তারা বলছেন, দ্রুত তদন্ত শেষ করে শাস্তি না দেয়ার ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমছে না। এতে করে দিন দিন প্রশাসনের ভাবমূর্তি কমছে।

জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, এসিল্যান্ডরা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেন। কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বিষয়টি তারা বলতে পারবেন। এছাড়া মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এ ব্যাপারে ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।

আমারসংবাদ/এসটি