আসাদুজ্জামান আজম
সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০, ০৬:৩৫ পিএম
শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা। শহীদ পরিবারের সন্তান। টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী। জাতির জনকের কন্যা হয়েও নৃশংস অমানবিকতার শিকার হয়েছেন তিনি। বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে হারিয়েছেন মা-বাবা, ভাই ও চাচাসহ নিকটাত্মীয়দের। খুনিদের অমানবিকার গুলি ঝাঁঝরা করেছিল ছোট ভাই শহীদ শিশু রাসেলের বুক।
স্বজনের রক্তে রঞ্জিত মাটিতে কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে ফুটিয়েছেন মানবতার ফুল। গণতন্ত্রের পথ সুগম করে জয় করেছেন কোটি মানুষের মন। অদম্য সাহসিকতা আর মানবতায় বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বজয় করেছেন। কারো কাছে তিনি মা, কারো কাছে আপা, কারো কাছে নেত্রী, যেভাবেই মূল্যায়ন হোক, মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে তিনি আজ সর্বত্র স্বীকৃত। বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় উন্নয়নের একমাত্র কাণ্ডারি রাষ্ট্রনায়ক। সেই মানবতার মা খেতাবপ্রাপ্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিন আজ।
যে বাঙালির মুক্তির জন্য জাতির পিতা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। পিতাকে হারিয়ে সেই বাঙালিকে নিজের আপনজন হিসেবে বাংলাদেশকে ভালোবেসে নিজেকে সঁপে দেন। গত চার দশকে জেল-জুলুম আর বারবার হত্যাকারীদের টার্গেটের মুখে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। স্বাধীনতাবিরোধী আর দেশি শত্রুদের জাতির জনকের বুকে বিদ্ধ বুলেটের টার্গেট পূরণের ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে অবিরাম ছুটে চলেছেন লক্ষ্য অর্জনে।
রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তো বটেই একজন মানবতাবাদী মা হিসেবে কোটি প্রাণে আলো ছড়িয়েছেন। নিজ সন্তানদের অনন্য উচ্চতায় আসীন করার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে অসংখ্য দুর্বিষহ জীবনের মা হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অসংখ্য ছেলে-মেয়েকে। ছায়ার মতো আগলে রাখছেন অসংখ্য অসহায় ও স্বজনহারানো সন্তানদের।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল উচ্চশিক্ষিত। তাদের দুজনেরই কর্মের গণ্ডি বাংলাদেশ পেরিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা এবং বাস্তবায়নে নেপথ্য কারিগর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতের নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ স্কুল, ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এবং হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ২০১৭ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘ইয়াং গ্লোবাল লিডার’ হিসেবে নির্বাচন করে। জয় ২০১৬ সালে জাতিসংঘের ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর আইসিটি’ লাভ করেন।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল একজন অটিজম বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিজ্ঞানী। অটিজম শিশুদের নিয়ে তার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। বাংলাদেশের অটিজমবিষয়ক পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান পুতুল। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুতুলকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে।
পুতুল ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল মনস্তত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৪ সালে স্কুল মনস্তত্বে বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়। সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) বিষয়ভিত্তিক দূত হিসেবেও কাজ করছেন। সিভিএফের চারজন দূত মনোনীত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। অন্য তিনজন হলেন— মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদ কামাল, ফিলিপাইনের ডেপুটি স্পিকার লরেন লেগ্রেডা এবং কঙ্গোর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ তোসি মাপ্নু।
রাজধানীর নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ২০১০ সালে ৩ জুন নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। সেই ভয়াবহ ঘটনায় স্বজন হারান তিন বোন রুনা, রত্না ও আসমা। সেদিন রাতে রুনার বিয়ে পান-চিনি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। রুনা ও রত্না বিউটি পারলারে গিয়েছিলেন। তাই আগুন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। মা-বাবাসহ স্বজন হারানো তিন বোনের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে চারপাশ। অসহায় এ তিন বোনের মা হিসেবে পাশে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা এখন শেখ হাসিনার মেয়ে হিসেবে পরিচিত। মা হিসেবে তিন মেয়েকে গণভবনে জাঁকজমক অনুষ্ঠান করে বিয়ে দেন শেখ হাসিনা। তিনজনেরই স্বামীকে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তিন বোনের পরিবারই এখন সন্তান নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছেন। রুনার সন্তান হওয়ার পর নাম রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। যে কোনো সমস্যায় তারা তিন বোনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী নয়, মা হিসেবে বিচারের আশ্বাস দেন শেখ হাসিনা। সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। বর্তমানে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ২৫ আসামির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
রোহিঙ্গা সারাবিশ্বে অতি পরিচিত একটি শব্দ। মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে স্বজন হারিয়ে রক্তাক্ত রোহিঙ্গা যখন বাংলাদেশে ঢুকতে আকুতি জানায়। বিশ্ব মানবতা যখন নির্বাক। ঠিক সে সময়ে মানবতার প্রতীক হিসেবে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের পাশে মায়ের ভূমিকায় আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানবিক কারণে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনার সাহসিকতা এবং উদারতা দেখে নেদারল্যান্ডসের নামকরা ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন গত বছর তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম করে ‘শেখ হাসিনা : মাদার অব হিউম্যানিটি’। জাতিসংঘ ও বিশ্ব মোড়লরা শেখ হাসিনার মানবিকতার প্রশংসা করেন। বিশ্ব নেতারা তার এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলি তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে।
সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর শনিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৫তম অধিবেশনে (ভার্চুয়াল) দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় প্রদান করেছে। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত দেশটি একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এ সময় রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন তিনি। ফিলিস্তিনের অমানবিক নির্যাতনের শিকার মানুষের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙালি জাতি অবর্ণনীয় দুর্দশা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে। সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছি।
অতি সম্প্রতি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের ছয়ফুল ইসলাম গত ২৫ বছর ধরে গরুর অভাবে নিজেই ঘানি টানছেন এবং তার স্ত্রী মোর্শেদা বেগম এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে আসছেন। হতদরিদ্র এই দম্পতি প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ঘানি টেনে যে পরিমাণ তেল ও খৈল উৎপাদন করেন তা বিক্রি করে তিন সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার চালান। গত ৯ সেপ্টেম্বর একটি দৈনিকে ছবিসহ নিউজ প্রচার হয়। সংবাদটি মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ঘানি টানার জন্য ছয় ফুল-মোর্শেদা দম্পতিকে একটি গরু এবং গরুটির রক্ষণাবেক্ষণ ও ঘানি মেরামতের জন্য ১০ হাজার টাকা উপহার দেন। সাহায্য পেয়ে ছয়ফুল ইসলাম দম্পতি আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করে দোয়া করেন। করোনা সংকটে সাধারণ মানুষ যখন বিপর্যস্ত, ঠিক সে সময়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) করোনা তহবিলে ১০ হাজার টাকা দান করে দেশবাসীর নজরে আসেন ভিক্ষুক নাজিম উদ্দিন। প্রায় দুই বছর ধরে ভাঙা কুঁড়েঘর মেরামত করার জন্য তিনি ওই টাকা জমিয়েছিলেন। একজন ভিক্ষুকের উদারতা আকৃষ্ট করে মানবিক প্রধানমন্ত্রীকে। পরে প্রধানমন্ত্রী ওই ভিক্ষুককে পাকা বসতঘর উপহার দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন পরিপাটি আবাসস্থল বারান্দাসহ বিশাল পাকা বসতঘরে দুটি শোবার ঘর, সংযুক্ত একটি রান্নাঘর ও একটি বাথরুম। আধা কিলোমিটার দূর হতে খুঁটি লাগিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করেন। রোজগারের জন্য একটি অটোরিকশাও উপহার দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার স্বপ্ন ছিলো অটিস্টিক কিশোরী মামিজা রহমান রায়ার। সোশ্যাল মিডিয়ায় রায়ার এমন ইচ্ছা প্রকাশ করেন তার এক শিক্ষিকা। সেই ভিডিও বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে রায়া নামের ওই কিশোরীর সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও ফোনে কথা বলতে পেরে দারুণ খুশি রায়া। শত ব্যস্ততার মাঝেও একজন অটিস্টিক কিশোরীর ইচ্ছাপূরণ করায় প্রধানমন্ত্রীর উদারতা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশংসার বন্যা বইছে।