Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪,

‘ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার লড়াই’

আবদুর রহিম

অক্টোবর ২৭, ২০২০, ০৬:২১ পিএম


‘ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার লড়াই’

র‌্যাবের ভাষ্যমতে, পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় ভবন আশিক টাওয়ারের ছাদে ছিলো ইরফান সেলিমের টর্চার সেল! সেখানে পাওয়া যায় মানুষের হাড়, উদ্ধার করা হয় হ্যান্ডকাফ, দড়ি, চাকুসহ নানা সামগ্রী। এছাড়া সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বাড়ির পাশে চকবাজারে আরও একটি টর্চার সেল রয়েছে বলেও র‌্যাবের দাবি।

রাজধানীর চকবাজারের দেবিদাস ঘাট লেনে হাজী সেলিমের বাসায় অভিযান চালিয়েও ‘টর্চার সেল’-এর সন্ধান মিলেছে। দুটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মদ, হাতকড়া, (ভার্চুয়াল প্রাইভেট সার্ভার) যন্ত্র, ৩৮টি ওয়াকিটকি, দেহরক্ষীর কাছ থেকে ৪০০ পিস ইয়াবা এবং ড্রোনসহ বিভিন্ন ডিভাইস উদ্ধার করা হয়।

এমন খবর প্রকাশে কাউন্সিলর পদ থেকে ইরফান সেলিমকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত আসে। সেলিমপুত্রকে নেয়া হয় কারাগারে। ডিএমপি কমিশনার ঘোষণা দেন ইরফান সেলিমের ঘটনায় কেউ প্রভাব খাটাতে পারবে না।

এমন নানা ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুরনো রূপ গরম হয়ে গেছে। এই ঘটনা টক অব দ্য কান্ট্রি। উত্তপ্ত ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারসহ নানা মাধ্যম। ঝড় বইছে প্রতিবাদ-বিতর্কের। অনেকে এটিকে ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার লড়াইও বলছেন।

সৈয়দ লিটু নামের একজন ফেসবুকে মন্তব্য করে লিখেন, ‘হাজী সেলিম সাহেবের ছেলেকে গ্রেপ্তার বা শাস্তি দেয়াতে সাধারণ মানুষের স্বস্তির কোনোই কারণ আমি দেখি না। এখানে লড়াইটা হয়েছে ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার। হাজী সেলিম সাহেবের ছেলে যে সরকারি প্রশ্রয়ের দম্ভে একজন নৌবাহিনীর অফিসারকে অপদস্থ করার সাহস করেছেন, একজন নৌবাহিনীর অফিসারও তার রাষ্ট্রীয় চাকরির পদ-পদবীর জোরে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন।

এখানে একজন অপরাধীর বিচার হয়নি বরং একজন অপরাধীর ক্ষমতা আর একজন ব্যক্তিগতভাবে অধিক প্রভাবশালীর ক্ষমতার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে হেরে গেছে। সামাজিক সুবিচার বা আইনের ন্যায়বিচারের এখানে কোনো ভূমিকা ছিলো না।’

ফাইজুন নাহার লিনা নামের আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘হাজী সেলিম ও তার ছেলে এরফান আওয়ামী লীগের কেউ না! আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের থেকে এমন বক্তব্য শুনার অপেক্ষায় জাতি...।’

আবদুর রহমান নামের একজন লিখেন, ‘হাজী সেলিমরা যেসব ক্ষমতাহীন মানুষের শতশত জমি দখল করেছে, তাদের টর্চার সেলে যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সর্বস্ব খুইয়েছে, তাদের অবৈধ মদের আখড়ায় যেসব মায়ের সন্তানরা তারুণ্য হারিয়েছে আমরা তাদের পক্ষে প্রশাসনের স্বপ্রণোদিত পদক্ষেপ চাই।’

রিফাত সিদ্দিকী নামের আরেকজনের মন্তব্য এমন— হাজী সেলিম বা ইরফান সেলিমকে আপনারা কেউ অমানবিক বলতে পারবেন না। কারণ তারা টর্চার সেলে নির্যাতনের পর কেউ আহত হলে দয়া দেখিয়ে স্যাভলন লাগিয়ে দিতো!

আব্দুল কাদের আরাফাত ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, থেকে যেতো হাজী সেলিমপুত্রের জঙ্গি আস্তানা। ভাইরালের অভাবে ক্ষমতার দাপট আর বিচারহীনতায় কত বোবা কান্নায় আকাশ ভারী হয় কে জানে! এই টর্চার সেলে এতদিন কারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, মানুষের হাড় কিভাবে আসলো তা কখনো জানা যাবে?

আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ লিখেন, হাজী সেলিমপুত্র এরফান সেলিমের টর্চার সেল থেকে হাড়সহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার! কত মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কত মানুষের কান্নার আওয়াজ চার দেয়ালের মাঝে মিশে গেছে!

আব্দুস সালাম লিখেন, হাজী সেলিম আওয়ামী এমপি নন। হাজী সেলিম বিদ্রোহী এমপি। হাজী সেলিম বিএনপির কমিশনার ছিলো। হাসান সালেহী রম্য করে লিখেন, হাজী সেলিম সাহেবের বাসায় অভিযানের পর... প্রচুর পরিমাণে জায়নামাজ, টুপি, আতর ও তাছবিহ উদ্ধার...। নয়ন মুরাদ কবিতার ভাষায় লিখেন, যতই করুন গলাবাজি... যার যা বলুন পিছে মসনদ থেকে ফুটপাত... খুব বেশি নয় নিচে।

কাউন্সিলর পদ থেকে ইরফানকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) কাউন্সিলর পদ থেকে সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, গতকাল মঙ্গলবার থেকে ইরফান সেলিম বরখাস্ত, একইসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে তাকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে।

গতকাল সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।

মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, সংবিধান ভিত্তিতে পরিচালিত। প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে খুব গুরুত্বের সাথে আইনের শাসনকে বিশ্বাস করেন। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক না কেন, অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। অপরাধী কোন দলের, কোন পদবিধারী এটা বিবেচনায় আনা হবে না।

তিনি বলেন, আপনারা যে কাউন্সিলরের কথা জানতে চাচ্ছেন তার অভিযোগটা আমাদের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। আমরা প্রসেস করছি, সম্ভবত আইনানুযায়ী আজকেই (মঙ্গলবার) তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হবে। আইনে যেভাবে আছে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পড়ে তার বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে বা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা হবে। তাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এ ধরনের অনেক অভিযোগ রয়েছে, হাজী সেলিমের ছেলের বিরুদ্ধেও রয়েছে।

কাউন্সিলররা যাতে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হতে পারেন সে বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোনো শ্রেণি-পেশাকে বা পদ-পদবীকে ভিন্নভাবে বিবেচনা করবো না। দেশের সব পেশা ও সব ধরনের লোকের মধ্যে ভালো ও মন্দ দুই কাজের মিশ্রণ আমরা প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করি। অনেকেই ভালো কাজ করেন। সব কাউন্সিলররা খারাপ কাজ করেন এটা আমি মনে করি না।

আবার কিছু কিছু কাউন্সিলর অনিয়ম, দৃষ্টিকটু ও নিন্দনীয় কাজের সঙ্গে কখনো সম্পৃক্ত হয়নি এটা বলা যাবে না। অপরাধীকে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।

তাজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে মামলা হয়েছে এবং কোর্ট থেকে রায়ও হয়েছে। যেহেতু বিচারাধীন একটি বিষয়, আমরা কোর্টের রায়টাকে আমলে নিয়ে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিতে হবে।

আজকে আমরা শুধু আইনগত কী কী করার আছে সেটুকু করতে পারবো এবং করবো। সেটা হলো সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা। এরপর পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু হবে। একজন ব্যক্তি যখন সাময়িক বরখাস্ত হয় আমার মনে হয় এটা একটা বড় শাস্তি।

কারাগারে ইরফান সেলিম ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে : সংসদ সদস্য হাজী মো. সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইরফান সেলিমকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে তাকে। গতকাল মঙ্গলবার বিষয়টি জানিয়েছেন ঢাকার জেলার মাহবুবুল ইসলাম।

তিনি জানান, এদিন ভোরে র্যাব হেফাজতে ইরফানকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়। করোনা ভাইরাস মহামারি চলাকালীন নতুন কয়েদিদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী কাউন্সিলর ইরফানও কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন।

ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী দীপু রিমান্ডে : নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে হত্যার চেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি এবি সিদ্দিক দীপুকে (৪৫) গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার এইচ এম আজিমুল হক জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে টাঙ্গাইল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নৌ-কর্মকর্তাকে সিদ্দিকই বেশি মারধর করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

দীপু ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী বলে জানা গেছে।

এরপর গতকাল ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট সত্যব্রত শিকদারের আদালতে এবি সিদ্দিক দীপুকে উপস্থিত করে পুলিশ সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। বিচারক পরে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

কেউ প্রভাব খাটাতে পারবে না : নৌবাহিনী অফিসারকে মারধর ঘটনার মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও এমপি হাজী সেলিমের ছেলে মো. ইরফান সেলিমের মামলার তদন্ত পুলিশ প্রভাবমুক্ত হয়ে করছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এখানে প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নাই।

গতকাল তেজগাঁও থানা কমপ্লেক্সে ভিক্টিম রেসপন্স ও হটলাইন নম্বর উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম।

ডিএমপি কমিশনার বলেন, এখানে প্রভাব থাকার কোনো প্রশ্ন নেই। চাইলে কেউ প্রভাব খাটাতে পারবে না। আমরা দ্রুততম সময়ে এই মামলার তদন্ত করবো ও অভিযোগপত্র জমা দেবো।

তিনি আরও বলেন, আমরা মামলাটি গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। সচরাচর হত্যামামলার মতো ঘটনা থাকলে ঘটনাস্থল উপ-পুলিশ কমিশনার পরিদর্শন করেন না। এই ঘটনার পরপরই রমনা বিভাগের ডিসি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।

আমারসংবাদ/এসটিএম